Thursday, December 24, 2015



সুরমা গাঙর পানি : ভাষাশৈলী
   
    সুব্রতা

     

   সাহিত্য একপ্রকার বাচনিক শিল্প (Verbal Art) । নৃত্য; ভাস্কর্য বা সঙ্গীতের মতো চারুকলার ক্ষেত্র থেকে সাহিত্য স্বতন্ত্র । কারণ ভাষার মাধ্যমেই ঘটে সাহিত্যের নান্দনিক সিদ্ধি । ভাষা যে পারস্পরিক ভাব বিনিময় বা জ্ঞাপনের (Communication) এর অন্যতম মাধ্যম তা আমরা জানি । প্রকারভেদে, প্রসঙ্গভেদে ভাষা আলাদা আলাদা হয় । সাহিত্যের এলাকায় ভাষারীতির ব্যাপারটিকে আমরা ‘শৈলী’ বলি অর্থাৎ ‘Style’ । যে কোনো ভাষা সম্প্রদায়ের ব্যবহৃত ভাষায় ব্যাকরণ রচনা করতে গেলে ভাষা গঠনের বিভিন্ন স্তর – ধ্বনিতাত্ত্বিক (Phonological), বাক্যতাত্ত্বিক (Stylistics), শাব্দিক (Lexical) প্রভৃতি যেরকম বিশ্লেষণ করা হয় তেমনি সাহিত্যের ভাষাশৈলী নিরূপণের ক্ষেত্রে ও একই ভাবে উপরোক্ত স্তর গুলি বিচার্য ।
     ভাষার মাধ্যমেই লেখক তাঁর জীবন সৃষ্টিকে তুলে ধরেন । ভাষাই সাহায্য করে লেখককে জীবনের সব বিচিত্র ঘটনা অবস্থা ইত্যাদিকে উপন্যাসে রূপায়িত করতে । কথাকার রণবীর পুরকায়স্থের “সুরমা গাঙর পানি” উপন্যাসের বয়ান / পাঠকৃতি বিশ্লেষণ যদি আমরা শৈলী বিজ্ঞান দিয়ে করি তাহলে অনেক অজানা তথ্যের সাথে সাথে লেখকের ভাষা নির্মাণের কাজ, লেখকের স্বাতন্ত্র্যের পাশাপাশি রচনাটির প্রকরণের কৌশল আমাদের কাছে আকর্ষণীয় হয়ে ওঠে ।
     বিশিষ্ট শব্দপ্রয়োগ, পদগঠন বা পদান্বয় ব্যবহারের প্রবনেতা, আলঙ্কারিক উদ্দেশ্য প্রভৃতি ভিন্ন ভিন্ন ভাষা লক্ষণ থেকে চিনে নিতে পারি লেখককে । অবশ্য লেখক নিজের স্টাইল সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বদলে ফেলতেই পারেন । তবে এই পরিবর্তন তত দ্রুত হয় না বলেই একটি বিশেষ সময়ে প্রচলিত লেখার ভঙ্গি অনেকক্ষেত্রেই চিহ্নিত করে ফেলা যায় । লেখক রণবীরের গল্পের ভাষা প্রথম দিকে অনেকটাই কঠিন যেখানে তাঁর ‘Text’ –এর তালা খুলতে গিয়ে পাঠককে অনেক সময়েই হোঁচট খেতে হয়, সেখানে পরবর্তী সময়ে লেখক লিখলেন উপন্যাস “সুরমা গাঙর পানি” যার ভাষা একেবারে সহজ এবং সরল । পাঠক অনায়াসেই নিজেকে একাত্ম করে নিতে পারে ‘Text’ –এর সঙ্গে ।
     “সুরমা গাঙর পানি” উপন্যাসের মধ্যে লেখকের Lexical Style বা শাব্দিক শৈলী ধরা পড়ে যখন লেখক তাঁর বয়ান Narrate/ বর্ণনা করছেন এভাবে ---
“ওপারে গুরু সৃষ্টি ধরের ভদ্রাসন দোকান ও শাকসব্জির ‘বিচরা’ ।”
“মা টিলার উপর নিয়ে যেত বাচ্চাটিকে, ‘ডিগরা’ দিয়ে আসত ।”
“হাকালুকি থেকে ও বড় । আর তাঁর ভিতর কত ‘কিসিমের’ মাছ ।”
“তিন চারটে খাগের টুকরো কাগজের ‘তাও’ কয়েকটা সাদা এবং ‘ছেরেং ভেরেং’ লেখায় ।”
“সুন্দরী মেয়েটার জন্যই মাছ ধরে দেয় বৈতল ‘নানানি বিনানি’ ।”
“প্রলয় রাতের অন্ধকারে বাপ বেটা বেরিয়ে যায় এক দড়ি আর এক মস্ত কলসি মাপের ‘খলুই’ হাতে ।”
স্থানীয় জীবনের বাতাবরণ দিয়েই আসলে লেখক তৈরি করেছেন তাঁর উপন্যাসের ভাষা ।
    যে কোনও লেখকই ভাষা-সংস্থানকে (System Of Languages) প্রয়োগ করেন নিজের ইচ্ছে অনুসারে, যার ফলে ভাষা প্রযুক্তির ক্ষেত্রে গড়ে ওঠে তাঁর নিজস্ব এক শৈলী । এখানে ‘বিচরা’, ‘ডিগরা’, ‘কিসিম’, ‘ছেরেং ভেরেং’, ‘নানানি বিনানি’, ‘খলুই’ প্রভৃতি শব্দের মধ্যে রয়েছে লেখকের নিজস্ব Style  বা শৈলী । বর্ণনার ভাষা মান্য হলেও আসলে তো তা তৈরি করতে হয়, লেখক সেখানে সচেতন ভাবেই স্থানীয় ভাষার কিছু কথাবার্তা ঢুকিয়ে দেন, সেটা টুকটাক ছোট করে । উদ্দেশ্য ‘Exception’ গুলোকে ‘Rule’ বানিয়ে ভাষাকে সমৃদ্ধ করা । আর লেখকের এই নিজস্ব ঘোরানাই পাঠাকের মন কেড়ে নেয়  ।
   “সুরমা গাঙর পানি” উপন্যাসে এমন অনেক শব্দ ব্যবহার হয়েছে যার আসলে কোনও মানে বা অর্থ নেই অথচ এর ধ্বনি সুন্দর, কানে ভালো শোনায় এরকম মজার মজার শব্দ । যাকে ধ্বনিতাত্ত্বিক শৈলী বা Phonological Style বলা যায় । যেমন ---
“ঝালের মুখে জিভের ‘চকাশ চকাশ’ আনন্দে মায়ের চোখ ও চিকচিক করে ।”
“খিত্তাগাউ বা রইদপুয়ানি ও যা দিতে পারে নি তাকে, তাই দিয়েছে ‘তেড়া বেঁকা’ এক নদীর পার ।
“ ‘পিটির পিটির’ বৃষ্টির সঙ্গে ‘পুটুর পুটুর’ বিড়ি ফুকতে ফুকতে এসে জড়ো হয় আরো দুই বন্ধু ।”
“তিন চারটে খাগের টুকরো কাগজের ‘তাও’ কয়েকটা সাদা এবং ‘ছেরেং ভেরেং’ লেখায় ।”
এরকম শব্দধ্বনির ফলে, উপন্যাস পড়তে গিয়ে যেন মনেহয় এর আলাদা একটা হৃদম রয়েছে । 
শুধু সংলাপে নয়, ঘটনা ও পরিবেশের ক্ষেত্রে এরকম অনেক শব্দ ব্যবহৃত হয়ে উপন্যাসের প্রাণ সৃষ্টিতে সাহায্য করেছে ।
    উপন্যাসে লেখক যখন বাক্য গঠন করছেন নিজের মতো করে সেখানে ওঠে আসছে তাঁর বাক্যতাত্ত্বিক শৈলী বা Syntactic Style । লেখক লিখছেন, --- 
“শব্দের উৎস কোথায় জানে না বৈতল । ধ্বনি দিয়ে যে শব্দ তৈরি হয় সে কি কোনো ভাষার, কোন ধর্মের । অতশত না জানলে ও তো চলে । বৈতল জানে তিন শব্দে শরৎ আসে বইয়াখাউরিতে, শিউলি ফোটে । বিলে শালুক ফোটে, পদ্ম চোখ মেলে । উৎসবের অগ্রদূত হয়ে আসে বাদ্যি, ঢ্যাম কুড়াকুড় ।”...
কিংবা সংলাপে লাখুদা যখন বৈতলকে জবাব দিচ্ছেন ---
“নালিয়া গাছ আর বড় করিয়া লাভ নাই কইছি, কচি দেখিয়া আগপাত বেচিলাউক মাইনষে গিট্‌টো দেওয়ার লাগি নিবা । খাইছ নি বা নালী গিট্‌ ।”
    এরকম বাক্যগঠন পাঠককে পরিচয় করিয়ে দেয় লেখকের লেখক সত্তার পাশাপাশি ব্যাক্তিসত্তার সাথেও ।
     প্রত্যেক আখ্যানের ভাষাশৈলীর দুটো ভাগ থাকে – বর্ণনা এবং সংলাপ । বর্ণনার ভাষা সাধারণত মান্য ভাষায় হয়, কিন্তু সংলাপের ভাষা মান্য ভাষা এবং স্থানীয় উপভাষা দুটোতেই হয় । এসব ক্ষেত্রে লেখকের ভাষাগত বৈশিষ্ট্য নির্ধারিত করে দিতে পারে তাঁর স্থানিক পরিচয় বা সামাজিক শ্রেণী । Class Dialect বা শ্রেণী-উপভাষার ব্যবহার লেখকের সামাজিক স্তর সম্পর্কে পাঠককে ওয়াকিবহাল করে । “সুরমা গাঙর পানি” উপন্যাসের সংলাপ রচিত হয়েছে স্থানীয় উপভাষায় । কাহিনীতে চরিত্রের সংলাপগত উপস্থাপনার ফলে প্রায় সব চরিত্রের আঞ্চলিক ও শ্রেণীগত পরিচয়টি পাঠকের কাছে স্বচ্ছ হয়ে ওঠে ।
    উপন্যাসের দুটি পর্বে – ভাটি এবং উজান পর্বে দুরকমের স্থানীয় উপভাষার ব্যবহার হয়েছে । ভাটি পর্বে সুনামগঞ্জ, হবিগঞ্জ, বইয়াখাউরির ভাষা দেখা যাচ্ছে আবার উজান পর্বে এসে শহরের সিলেটী এবং কাছাড়ি উপভাষার এক জগাখিচুড়ি ভাষা সৃষ্টি হয়েছে । দেশভাগের সময়ে সিলেটে গ্রামে গ্রামে, এলাকায় এলাকায় একরকমের ভাষা দেখা যাচ্ছে আবার যখন কাহিনী উজান পর্বে চলে আসে তখন ভাষার একটা মিশ্রণ দেখা যাচ্ছে । ভাটি পর্বে হিন্দুরা সবাই উচ্চবর্ণের এখানে এসে ভাষা মিশে গেছে । উজানপর্বে স্থানীয় এরা কোথা থেকে আসে নি । তাদের একটা নিজস্ব কাছাড়ি উপভাষা রয়েছে । সেটা মুসলমানদের মুখের কথ্য ভাষা । উপন্যাসে আমরা লক্ষ্ম্য করলে দেখব বৈতল যখন তার মুসলমান বন্ধু লুলার সাথে কথা বলছে সে বলছে ‘তুই’ আবার লুলা যখন বৈতলকে কিছু বলছে, বলছে ‘তুইন’ । ‘তুই’ সম্বোধনটা ‘তুইন’ হয়ে যাচ্ছে । উজান পর্বে এসে সব মিশে গিয়ে মুসলমানি কাছাড়ি উপভাষা হয়ে যাচ্ছে । দুখু বৈতলের সংলাপেও তা দেখা যায় ---
“হুনছি তো । ‘তুইন’ কইছে । তুইন অতো পাকিস্তান তনে আইচছ ।”
“আইছিতে কিতা, আমি অখন পাকিস্তানি নি । ‘তুইতো’ হালার হালা গদ্দার ।”...
    উপন্যাসে ব্যবহার হয়েছে নাগরিক ভাষা, ব্যবহার হয়েছে একেবারে সাধারণ খেঁটে খাওয়া মানুষের ভাষা । উঠে এসেছে গ্রামিন বৈশিষ্ট্য, গ্রামের কিছু বোকা বোকা ব্যাপার, গ্রামের মানুষের মনের কথা মুখের ভাষা । রয়েছে অনেক সুস্বাদু খাবারের উপকরণ একেবারে স্থানীয় ভাষায় স্থানীয় রীতিতে । মুখের ভাষার মধ্যে ওঠে আসে সামাজিক অবস্থান, সমাজের কথা ---
“না গো না, মা বিষরি । কেউ কেউরে খেদায় না । মানুষ মানুষর শত্রু নায় । খালি দুই একজন আলদর বাইচ্চা থাকে । শয়তানি করে ।”
    লেখক নিজস্ব সৃষ্টির প্রয়োজনেই উপন্যাসে চরিত্রের কল্পনায়, ভাষার গঠনে ব্যবহার করেছেন লোকসাহিত্যের নানা দিক, যা উপন্যাসের ভাষাকে নতুনত্ব এনে দিয়েছে । অনেক লৌকিক ছড়া ও গানের ব্যবহার হয়েছে উপন্যাসে যা সহজেই পাঠকের দৃষ্টি কেড়ে নেয় ।
 ‘ছাতক তনে আইলা এক আড়ুয়া, যাইতা বদরপুর ।
                   সিলট আইয়া জিগার করলা, জৈন্তা কতদূর ।’
বা বৈতল যখন শেখাচ্ছে মেয়েকে ঘুঙ্গিঘুঙ্গি খেলা । ঘুঙ্গিরে ঘুঙ্গি তোর বাড়ি কৈ । দুল দুল দুলনি রাঙা মাথায় চিরুণি, দুপায়ের উপর মেয়েকে বসিয়ে দোলাতে দলাতে বৈতলের গলা চড়ে সবার আগে আর বলতে থাকে হেট্‌ ঘোড়া বদরপুর, মঙ্গলবাজার কতদূর । উপন্যাসে বৈতলের মেয়ের সবচে মজার খেলা হল গু খাওয়ার ছড়া,  
‘একখান কথা,
কী কথা ।
বেঙের মাথা ।
কী বেঙ ।
ঘাড়ু বেঙ ।
কী ঘাড়ু ।
বাবন গরু ।
কী বাবন ।
ভট বাবন ।
কী ভট ।
গুয়া কট ।
কী গুয়া ।
ছাও গুয়া ।
কী ছাও ।
গু খাও ।’
উপন্যাসে এরকম স্থানীয় লোকখেলা, লোকভাষা, লোকগান, ছড়া প্রভৃতি ব্যবহার করে পাঠককে আলাদা আনন্দে ভরপুর করে দিতে সক্ষম হয়েছেন লেখক । 
     বলা হয়ে থাকে ভাষা সৃষ্টির জন্যে অন্তত দুটো মানুষের অস্তিত্ব প্রয়োজন । সাহিত্যে যখন সংলাপ হচ্ছে দুটো মানুষের মধ্যে বা চরিত্রের মধ্যে তখন সৃষ্টি হচ্ছে নতুন ভাষার । উপন্যাসে প্রধান চরিত্র বৈতলের সঙ্গে অন্য চরিত্রের সংলাপের মধ্য দিয়েই সৃষ্টি হয়েছে নতুন অর্ন্তবয়ান । আর যখনই একের বেশি দুয়ে আমরা আসি তখনই সৃষ্টি হয় সমাজ --- “সুরমা গাঙর পানি” উপন্যাসের মধ্যে তেমনি ওঠে এসেছে সেই সমাজের ভাষা, মাছ মারাদের জীবনকাহিনী । স্থানীয় ভাবধারা, জীবন প্রণালী, রীতিনীতি, আচার ব্যবহার একেবারে স্থানীয় ভাষায় নিজস্ব রীতিতে নিজস্ব ঘরানায় উপন্যসে সার্থকভাবে তুলে দিয়েছেন লেখক ।   
     আর ভাষাবিজ্ঞান, শৈলীবিজ্ঞান দিয়ে যখন আমরা “সুরমা গাঙর পানি” উপন্যাস পাঠ করি তখন শুধু জীবনানুভূতির তত্ত্বকথাই নয়, পাই লেখকের নিজস্ব শিল্পকলাও ।  




অঙ্গীকার, পূজো সংখ্যা ২০১৫ 
শিলচর ।