Monday, May 27, 2024

হলুদ বসন্ত --- সুব্রতা মজুমদার

 


(রবিবারের বৈঠক, দৈনিক যুগশঙ্খ, রবিবার ২ আগস্ট, ২০১৫। পৃষ্ঠা ৯)

জ আমার চতুর্থমঙ্গল। কথায় বলে সময় এবং স্রোত কারও জন্য অপেক্ষা করে না। মানুষের জীবনেও বয়ে যাওয়াতেই আনন্দ, কিন্তু আমাদের চারপাশের উপরই আসলে নির্ভর করে তার থেমে থাকা এবং বয়ে যাওয়ার। কোনও সময়ই হয়তো খারাপ নয়, আমারও সেই সময়টা হয়তো ভালোই ছিল অন্যরকমভাবে।

তখন এমএ পাশ করেছি মাত্র, অনেক স্বপ্ন নিয়ে হাঁটছি। পিএইচডি করব, টি এস এলিয়টকে নিয়ে মন দিয়ে কাজ করব, কলেজের প্রফেসর হব, ইনোভা নিয়ে ঘুরবো, আরও কত কী! কিন্তু আমার সব স্বপ্নে জল ঢেলে দিয়ে ইউনিভার্সিটি বলল, অফিসিয়াল কিছু কারণে আমার এখন আর পিএইচডি হচ্ছে না। নেটেও দুবার বসে ব্যর্থ। ভাঙা মন নিয়ে উপায় তখন একটাই, বাবার পান দোকানে বসা। বিশুর পান বলে বাবার পান দোকান রংপুরে পরিচিত। এরকম পরিচিতি আগে ছিল না। বিশ বছর আগে মা দোকানটাকে ধরে রেখে দাদা আর আমাকে পড়িয়েছে। বড়পিসি তখন মাকে বলেছিল, মেয়ে হয়ে আবার দোকান চালাবে নাকি। অভাব দেখে বড়পিসি ওর মামার বাড়িতে চলে যায়। মা বাবাকে ছেড়ে যায়নি কোথাও। এইতো সেদিন যখন বিয়ে করতে যাব, দাদা ধুতি পরিয়ে দিচ্ছিল। মনে পড়ছিল শৈশবে দাদা আর আমি যেরকম কষ্ট করেছি তেমনি মজাও করতাম খুব। বিশ্বায়নের ঠেলায় অনেক কিছু এখন পালটে গেলেও খুব একটা পরিবর্তন এখনও হয়নি।

একদিন আমরা সন্ধেবেলা পড়তে না বসে রাস্তায় খারাপ হয়ে যাওয়া একটা বিয়ের গাড়ি দেখতে চলে যাই। দাদাই আমাকে নিয়ে যায়, ‘আয় আয় নতুন বউ দেখবি' বলে। মা সাধারণত বকে না, কিন্তু সেদিন বকেছিল। আমরা বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে পড়ি। রাস্তায় রাস্তায় ঘুরি, আমার পকেটের একটাকা দিয়ে ডালমুট কিনে খাই। রাত যত হতে লাগল ভয়ও বাড়তে লাগল। হঠাৎ একসময় সামনে একটা টর্চের আলো দেখে শান্তি পেলাম দুজনেই। বাড়ি ফিরলাম। দাদা যখন ক্লাস এইটে হোস্টেলে চলে যায়, আমি তখন সিক্সে, বাড়িতেই থাকলাম। মা খুব কষ্টে ও বুদ্ধি করে দোকান চালিয়ে দাদা ইঞ্জিনিয়ারিং আর আমি এমএ করি। নদীর পারেই আমাদের বাড়ি। ছোটবেলা আমাদের কেটেছে নদীর পারে পারে বাঁশি নিয়ে খেলে। পাড়ায় একজন কাকা ক্লাসিক্যাল গানবাজনা শেখাতেন। আমার আগ্রহ দেখে আমাকেও মোটামুটি শিখিয়ে দেন, কিন্তু অস্বস্তিকর সেই সময়টাতে বাঁশিও বাজাতে মন চাইত না। প্রায় প্রতি রোববারই কোনো না কোনো ইন্টারভিউ থাকত, কিন্তু হচ্ছিল না চাকরি কোনদিকেই। মন খারাপ করে বসে থাকাটাই স্বাভাবিক। সেদিন বাবার ওষুধ আনতে ক্লিনিক যাচ্ছি, রাস্তায় প্রেমতলার মোড়ে হিমাংশুর সঙ্গে দেখা, ও আমার কলেজের বন্ধু। গার্লফ্রেন্ডকে নিয়ে রেস্টুরেন্টে থেকে বেরোচ্ছে। আমাকে দেখে বলে,

--- ওই রাহুল দাঁড়া, কেমন আছিস?

ভাবলাম বলি, ভাই আমার বাইক নেই, চাকরি নেই, গার্লফ্রেন্ড নেই, কেমন আর থাকব। পরে মনে হল ওকে ওসব বলে লাভ নেই, তাই বললাম, এই তো ভাই, ভালো। তুই বল.....

মিনিট পাঁচেক কথা হল ওর সঙ্গে। ওর খুব তাড়া ছিল জিএফ-কে তাড়াতাড়ি বাড়ি পৌঁছে দিতে হবে বলে। বলাবাহুল্য আমার তখন কোনও তাড়া নেই, যেখানে যাই প্রচুর সময়। আর এমনিতেও আমার বন্ধুদের সঙ্গে আমার ইউনিফর্ম আর সিলেবাস ছাড়া আর কিছুরই মিল ছিল না। আমার মায়ের জ্যোতিষে বিশ্বাস। আমার এই অবস্থা দেখে জ্যোতিষ কালাদাকে ডাকল।

কালাদা দেখে বলে, মঙ্গল শনি, কেতু, শুক্র সব খারাপ। প্রতিকার করতে হবে। আমি ওসব পছন্দ করি না বলে ওকে দেখলেই মাথা খারাপ হয়ে যায় আমার। মনে হচ্ছিল, তাড়িয়ে দিই। ব্যাঙ্কে যাওয়া, সিলিন্ডার আনা, ওষুধ কিনে আনাই তখন আমার কাজ। সেদিন মা বলে, ব্যাঙ্ক পাসবুক আপডেট করিয়ে আনতে। গেলাম ব্যাঙ্কে। সেখানে আমার পাশেই চেয়ারে বসা মেয়েটি আমাকে দেখে হাসছিল। মনে হচ্ছিল অকারণে অমন হাসছে কেন, তাই আমিও রেগে গিয়ে বলি, এক্সকিউজ মি! হাসির কারণ জানতে পারি? আসলে আমার শার্টের কলারে ছোট্ট একটি প্রজাপতি বসেছিল, যেটা অনেক্ষণ ধরেই আমি খেয়াল করিনি। ও সেটা দেখিয়েই বলে, রি, না মানে, ওই যে প্রজাপতিটা কী সুন্দর!

তারপর দুজনেই হাসলাম। প্রায় আধঘণ্টা কথা হল দুজনের। আমি বাড়ি ফিরেই ফেসবুকে ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠিয়ে দিলাম। মাস দুয়েকের মধ্যেই বন্ধুত্ব প্রেমে বদলে যায়, আর আমার মোজার গন্ধে টইটুম্বুর ঘরে মৌ প্রেমের ধূপকাঠি জ্বালিয়ে বাতাবরণ বদলে দেয়।

 

মৌয়ের বাবা মেডিক্যাল কলেজের ডাক্তার। মালুগ্রামে বিশাল বড় বাড়ি ওদের। আমার সেরকম কিছু না থাকা সত্ত্বেও আমাকে ভালোবেসেছে, এমনই ভালো মনের মানুষ সে। একদিন মন খারাপ করে ফোন করে, মা আমার জন্য পাত্র ঠিক করেছেন, ডাক্তার।

- ভালো, বিয়ে করে ফেলো।

আমার কথা শুনে ও রেগে ফোন কেটে দেয়। ওর বাবার সামনে গিয়ে দাঁড়ানোর ক্ষমতা আমার নেই, তা-ও গেলাম। ওর মা-বাবা আমাকে স্নেহই করতেন ওর বন্ধু বলে। ওর বাবা আমাকে দেখে বললেন, বলো রাহুল, কী করছ আজকাল?

আমি বলার সুযোগ পেয়ে হড়হড় করে সব বলে দিলাম। শান্ত স্বভাবের ওর বাবা আমাকে ওর বন্ধু হিসেবেই মেনে নিলেন, মেয়ে জামাই হই এটা পছন্দ হল না। বললেন, দেখো, তোমার সামনে প্রচুর সময় আছে, মন খারাপ করো না, এগিয়ে যাও জীবনে। আমার তো একটাই মেয়ে, তাই ওকে ভালো কাজকর্ম করে, ভালো বংশের এরকম ছেলের সঙ্গেই বিয়ে দেওয়ার ইচ্ছে। আমরা বাংলাদেশের প্রয়াগ মহলের চৌধুরী। তোমাদের আদি বাড়ি কোথায় বলতে পার ?

বললাম, না।

বেরিয়ে আসার সময় মৌয়ের দিকে তাকালাম একবার; অনুভব করছিলাম ওর বুক ফেটে যাওয়ার যন্ত্রণা। আমার কি কিছু কম হচ্ছিল যন্ত্রণা। কিন্তু কিছু করার ছিল না, কারণ আমি তখন এক কাঠ বেকার যুবক রাহুল। বাড়ি ফিরে মৌয়ের সব ফোন কল অ্যাভয়েড করতে লাগলাম। জেদ তখন একটাই- চাকরি চাই। একটা চাকরি আমাকে জোগাড় করতেই হবে। মাথা যখন একটু ঠান্ডা হল পালটা ফোন করলাম। কিন্তু ও তখন আর রিসিভ করল না। দিন কয়েকের মধ্যেই ওর বিয়ে হয়ে যায় ডাক্তার অরূপ দত্তের সঙ্গে। আমার বন্ধু সুমিতের মুখে নাম শুনে চিনলাম অরূপ দত্তকে। ওর কাকা তার শালার বৌকে জ্বালিয়ে মেরেছে তাও ওদের বংশ ভালো! আমার মাথায় তখন অনেকগুলো ভাবনা, এর মধ্যে জায়গা বদলটাকেই বেছে নিলাম। অনেক খুঁজে খুঁজে সিপেঞ্জুরি চা-বাগানে চাকরি পেলাম। কিন্তু কাজের ফাঁকে কথা প্রসঙ্গে মৌয়ের কথা মনে পড়েই যেত।

 

প্রথম দিন বাগানের বাংলোয় ঢুকে দারুণ লাগছিল। দুজন কাজের লোক। বেরিয়ে এল আমাকে দেখে। একজন মালী, আরেকজন রান্নার লোক। আমার রান্না করে দেবে দশ-বারো বছরের ওই মেয়েটাকে দেখে মনে হল, তিন লিটারের প্রেসার কুকারে পাঁচ লিটারের গ্যাসকেট লাগিয়ে হুইশল দেবার ব্যবস্থা করা হয়েছে। এটা চা-বাগানে নতুন নয়, অনেকদিনের। সে যাইহোক, ওড়িয়া ওই মেয়েটা যে কী বলে আমি তার কিছুই বুঝতে পারি না, এই প্রথম উপলব্ধি করলাম ভাষা না জানা কত সমস্যার। প্রথমেই বলল, সাহাব জুয়ার! (জোহার)  

ওর দুহাত জোড় দেখে বুঝলাম নমস্কার করছে। বললাম,

---হুম্।

--- অভি খায়েগা, না কতলা খায়েগা?

আকার ইঙ্গিতে বুঝলাম যে কখন খাবো। এরকম করেই আকার ইঙ্গিতে চার-পাঁচ দিন যায়, ওরও অসুবিধে হচ্ছিল তাই আর আসেনি। মালী আরেকজনকে ঠিক করে দেয় নইলে ওকেই রাঁধতে হত। ভাবলাম সেই একই হবে, আবার আকার ইঙ্গিত, কী সমস্যায় পড়লাম! ও গ্লাসে জল নিয়ে এসে বলে, সাহাব নমস্তে!

--- হুম।

--- আভি খানা লাগাদে ?

--- বাহ রে! তুমকো হিন্দি আতি হ্যায়?

-- হ্যাঁ সাহাব, থোড়া বহুত৷

--- হুম। আর বাংলা পারিস না?

--- হামি উইটা হিন্দি থেকেও ভালো জানি।

--- ওহ, গুড! কী নাম তোর?

---পনোতি।

 

পনোতি বেশ যত্ন করেই আমার দেখভাল করছিল। ওর পরিবার বলতে ওর পিসি, আর কেউ নেই। পিসির সঙ্গেই থাকে, আর যা রোজগার করে পিসিকেই সব দিয়ে দেয়। বুঝলাম যে কোনও দিন বাড়ি ফিরে না খেয়েই শুয়ে পড়ে। পিসি ওর জন্য খাবার রাখতে ভুলে যায় কিন্তু ওর তলব ঠিকার হিসেবে নিতে ভোলে না। এসব জানতে পেরে দুপুরের খাবার ওকে পেট ভরে আমার বাংলোতেই খেতে বলি, তখন থেকে ও আমাকে আরও কদর করতে থাকে। চা-বাগানে আমার কোনও দিনই কোনো ইন্টেরেস্ট ছিল না। ভাততাম চা-বাগানে মানুষ থাকে নাকি, কিন্তু পনোতি আমার সে ধারণা পালটে দিয়ে বাগানের সঙ্গে আমার পরিচয় করিয়ে দেয়। চারদিক সবুজ, নীল আকাশ, সাদা বক উড়ে যায়, সকালে এক পাখি ডাকে, দুপুরে আরেকটা, বিকেলে আবার আরেকটা। এ যেন স্বপ্নের দেশ! একদিন বিকেলে সুন্দর আকাশটাকে দেখিয়ে পনোতি বলে, সাহাব, আকাশটা দেখো, কী সুন্দর না! কিন্তু ছুঁতে পারবে না। আর উই পাখিটাকে চিনো? উইটা হলুদ বসন্ত, উই সজনা গাছটায় বসেছিল, যাহ! উড়ে গেছে।

ওর কথা শুনে মনে হল, ধুর মেয়ে, এত মনের কথা বলছিস। কী করে বললি! প্রসঙ্গ পালটে বলি,

--- তুই ওড়িয়া না ?

হোঁ।

--- একটা ওড়িয়া গান করতো!

---গান জানি না, ছড়া বলি?

--বেশ। বল।

---নাণ্ডি মুণ্ডি পাই টেঙ্গরি

শিমলো গছে বসা

ধাঁই আরে পাইকো বুড়ো

নাণ্ডি কে নেলা মুশা।

এর মানেটা ও আমাকে বোঝাতে পারেনি যদিও তবে ওর হাসি দেখে বুঝেছিলাম যে ওটা হাসির ছড়া, আমিও হাসলাম।

মৌকে যখন ভীষণভাবে মিস করতাম তখন ইন্টারনেটে বাঁশি শুনতাম খুব। ফ্লুটিস্ট এসবি রামনাথ আমার খুব প্রিয় শিল্পী। বাজনা শুনতে শুনতে হঠাৎই মনে হল ওর সঙ্গে যদি কথা বলা যেত তাহলে চাকরিবাকরি ছেড়ে চলে যেতাম সংগীত জগতে। অনেক খুঁজে গুগল প্লাসে জুড়ে গেলাম। সঙ্গে সঙ্গে মেল এল, হ্যালো বলে। আমি চমকে উঠি, বলি, হ্যালো, আই অ্যাম অ্যা ফ্যান অব ইয়োর....

--- অহ্, থ্যাঙ্কস। তুমি বাঁশি বাজাও?

--- ওই আরকি একটু আধটু। কিন্তু আপনি বাংলা বলতে পারেন?

--– হ্যাঁ, আমি বাঙালি। আমার বর সাউথের, ও তবলা বাজায়, গুরুজি মানে পণ্ডিত হরিপ্রসাদজির সঙ্গে, দেখোনি?

--- ওহ্, হ্যাঁ দেখেছি।

--- আর বলো, মিউজিক কীরকম চলছে?...

তারপর রামনাথদির সঙ্গে প্রায়ই কথা হতে থাকে, যেন আমার অনেকদিনের বন্ধু। দিদি আমাকে আবার মিউজিক শুরু করতে বলে। একদিন স্কাইপ করে দিদি আমাকে পাও জি ম্যানে রামরতন ধন ভজন আর একটা ফিউশন শোনায়। বাজনার স্টাইল দেখে বললাম অসাধারণ দিদি ! আমাকেও নিয়ে যাও তোমার ওখানে আমি তানপুরায় সুর ধরে রাখবো।

দিদি হেসে বলে, চলে এসো। কিন্তু আগে তোমার তারগুলো সব ঠিকঠাক করে লাগাও, ওগুলে উলটোপালটা লাগানো রয়েছে।

আমি আবার বলি, দারুণ ফিউশন বাজাও দিদি মন ভরে যায়। তোমার ওই আঙুলগুলো আমাকে দিয়ে দাও, আমি ল্যামিনেশন করে রাখবো।

দিদি আবার হাসে, হে হে হে, ধুর! আমার আঙুলগুলো কত সুন্দর! চ্যাপটা হয়ে যাবে না ল্যামিনেশন করলে?

আমার কাজ তখন একটাই। অফিসে গিয়ে রামনাথদির সঙ্গে চ্যাট, কাজের ফাঁকে মৌকে ভাবা বাংলোয় ফিরে পনোতির চা-বাগান নিয়ে গল্প আর আমার প্রিয় ডিম-আলুর ঝোল। এরকম কাজকর্ম কোন বাগান কর্তৃপক্ষ মেনে নেবে? একদিন নোটিশ চলে এল, আমিও রিজাইন দিয়ে দিলাম। বাংলোয় ফিরতে সন্ধ্যা। সোজা রুমে গিয়ে শুয়ে পড়লাম। পনোতি দরজায় দাঁড়ায়, বলে, সাহাব চা খাবে? আর রাতে কী বানাব?

--- জানি না রে।

বাইরে বৃষ্টি হচ্ছিল দেখে ও আমার রুমের জানালাগুলো বন্ধ করছিল, আমি না করলাম, টা  খোলাই থাক। তুই যা না রে এখান থেকে।

ও চলে গেল। যখন ঘুম ভাঙল তখন সকালব্যাগ গুছিয়ে বাড়ি ফিরে এলাম। চলে যাব শুনে পনোতি আর দেখাই করল না এসে। প্রকৃতি ঘেঁষা এরা, রা এরকমই হয়। দূরের লোককে যেমন আপন করতে জানে তেমনি অভিমানীও।

আমার ভাঙা নৌকা আবার মাঝদরিয়ায়। শুরু হল আবার ইন্টারভিউ দেওয়া। তবে এইবার হয়ে গেল এসএসসি-র পরীক্ষায় সিলেকশন হয়ে যায় আমার চাকরি পেয়ে পাঁচ মাসের মধ্যেই একটা ফ্ল্যাট করলাম একটা গাড়িও করলাম। আর পিছিয়ে নেই ; সময়ে সঙ্গে পা ফেলে এগোতে লাগলাম। আমার অফিসে অসমিয়া বান্ধবী সৃষ্টি হৃদয় জুড়ে বসে আর আমার বেসুরো বাঁশি সানাইয়ের সুরে বেজে ওঠে।

 

 

***** 

Wednesday, February 14, 2024

সরস্বতী বন্দনা

 

      সরস্বতী বন্দনা   

ত্বং ত্বং সরস্বতী নির্মলো বরণে  

হরে হরে মুকুতা গজমোতি হার  

দেও দেও সরস্বতী বিদ্যার ভার  

ওঠো ওঠো সরস্বতী   

মোর কণ্ঠে বইশো   

যাবৎ জীবন তাবৎ থাকো   

দিনে দিনে বিদ্যা বাড়িতে থাকো।  (প্রণাম)


   [জ্ঞান, সঙ্গীত ও শিল্পকলার দেবী সরস্বতীর এই মন্ত্রটি বা বন্দনাটি আমাকে শিখিয়ে ছিলেন আমার এক দাদু (আমার মা র মেসোমশাই শ্রদ্ধেয় হিমাংশু সেন (রুনু), উনি ছিলেন বরাক উপত্যকার করিমগঞ্জ জেলার একটি গ্রাম মাইঝগ্রাম এর একজন জমিদার। তৎকালীন কেন্দ্রীয় শিক্ষামন্ত্রী তথা যাদবপুর বিশ্ব বিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা উপাচার্য ডক্টর ত্রিগুণা  সেন এর ভাইপো। এরকম একজন ব্যাক্তির সঙ্গে যখন আমার পরিচয় হয় তখন আমি একেবারেই ছোট, ক্লাস ওয়ান টু তে পড়ি হবে। এখন উনি বেঁচে থাকলে হয়তো অনেক কাজের তথ্য আরও পেতাম। এবারে প্রশ্ন তিনি এটি আমাকে শেখালেন কেন? আমার বাল্যবন্ধু জয় (রূপজ্যোতি ভট্টাচার্য) কে দেখতাম রোজ স্নান করে ভেজা শরীরে গামছা পরে সূর্যের দিকে তাকিয়ে প্রণাম করে 'জবা কুসুম' মন্ত্র বলে। পুরো মন্ত্র টন্ত্র বলে শেষে  আরও একটা কি জানি বলে একটা লাইন বলত 'কাঁথা নিল শিয়ালে, আনিয়া দিল বিয়ালে' লাইনটা আমাকে খুব আকর্ষণ করত, বুঝতাম না 'বিয়ালে' ভাবতাম, কাঁথা শেয়াল নিয়ে গেছে বেড়াল ফেরত দিয়ে যাবে। আমি এই কথা শুনে খুব মজা পেতাম জেনে সেও চিৎকার করে করে শুনিয়ে শুনিয়ে বলত। ভাবতাম এটাই 'জবা কুসুম' মন্ত্র সবাইকে বলতাম আমাকেও 'জবা কুসুম' পুরো মন্ত্রটা শিখিয়ে দিতে, সবাই বলত যে ওই মন্ত্র মেয়েরা বলে না শুধু ব্রাহ্মণ ছেলেরাই বলতে পারে। 

    একদিন মা র সাথে মাইঝগ্রাম দাদুর বাড়ি বেড়াতে যাওয়া হয়, সেখানে দাদুকে বলি মন্ত্রটি শিখিয়ে দিতে। দাদু বললেন এই মন্ত্র না হলেও উনি সরস্বতীর একটা মন্ত্র শিখিয়ে দেবেন আর রোজ  স্নান করে বলতে। কথা মতো বড়ো একটা পুকুর পারে নিয়ে গিয়ে মাছ ধরতে ধরতে এই মন্ত্রটি শিখিয়ে দিলেন। আমি ছোটবেলা থেকেই রোজ স্নান করে কবিতাটি মন্ত্রের মতো বলেছি এখনও অভ্যাস মতো কখনও হয়ে যায় বিড়বিড় করে, কিন্তু যখনই কাউকে জিজ্ঞেস করি এটা জানো? বলে না। এখন প্রশ্ন জাগে মনে তাহলে কী ওটা ওনার নিজস্ব লেখা? অনেক সার্চ করে একটি লেখা পেয়েছি গুগোলে মিলে যায় কিছুটা কিন্তু হুবহু নয়। এই মন্ত্রটি বা সরস্বতী বন্দনাটি এখানে ব্লগে তুলে রাখার কারণ আছে যদি সত্যি এটা ওনার লেখাই হয়ে থাকে তাহলে আমার সাথে যাতে এটাও একদিন হারিয়ে না যায়। সবার কাছে পৌঁছে দিতেই এখানে তুলে রাখা। কে জানে এই মন্ত্র বলেই যদি লেখাপড়ায় খুব খারাপ থাকা ছেলেমেয়েরাও মা সরস্বতীর বর পেয়ে যায় আর পড়াশোনায় মনোযোগ চলে আসে! 😃 সঙ্গে পোস্টটি পড়ে কারো যদি মনেহ্য় এই মন্ত্রটি বা সরস্বতী বন্দনাটি জানা আছে তাহলে অবশ্যই জানাবেন।] 

ধন্যবাদ, 

ড. সুব্রতা মজুমদার, শিলচর, আসাম।    


    



Thursday, December 24, 2015



সুরমা গাঙর পানি : ভাষাশৈলী
   
    সুব্রতা

     

   সাহিত্য একপ্রকার বাচনিক শিল্প (Verbal Art) । নৃত্য; ভাস্কর্য বা সঙ্গীতের মতো চারুকলার ক্ষেত্র থেকে সাহিত্য স্বতন্ত্র । কারণ ভাষার মাধ্যমেই ঘটে সাহিত্যের নান্দনিক সিদ্ধি । ভাষা যে পারস্পরিক ভাব বিনিময় বা জ্ঞাপনের (Communication) এর অন্যতম মাধ্যম তা আমরা জানি । প্রকারভেদে, প্রসঙ্গভেদে ভাষা আলাদা আলাদা হয় । সাহিত্যের এলাকায় ভাষারীতির ব্যাপারটিকে আমরা ‘শৈলী’ বলি অর্থাৎ ‘Style’ । যে কোনো ভাষা সম্প্রদায়ের ব্যবহৃত ভাষায় ব্যাকরণ রচনা করতে গেলে ভাষা গঠনের বিভিন্ন স্তর – ধ্বনিতাত্ত্বিক (Phonological), বাক্যতাত্ত্বিক (Stylistics), শাব্দিক (Lexical) প্রভৃতি যেরকম বিশ্লেষণ করা হয় তেমনি সাহিত্যের ভাষাশৈলী নিরূপণের ক্ষেত্রে ও একই ভাবে উপরোক্ত স্তর গুলি বিচার্য ।
     ভাষার মাধ্যমেই লেখক তাঁর জীবন সৃষ্টিকে তুলে ধরেন । ভাষাই সাহায্য করে লেখককে জীবনের সব বিচিত্র ঘটনা অবস্থা ইত্যাদিকে উপন্যাসে রূপায়িত করতে । কথাকার রণবীর পুরকায়স্থের “সুরমা গাঙর পানি” উপন্যাসের বয়ান / পাঠকৃতি বিশ্লেষণ যদি আমরা শৈলী বিজ্ঞান দিয়ে করি তাহলে অনেক অজানা তথ্যের সাথে সাথে লেখকের ভাষা নির্মাণের কাজ, লেখকের স্বাতন্ত্র্যের পাশাপাশি রচনাটির প্রকরণের কৌশল আমাদের কাছে আকর্ষণীয় হয়ে ওঠে ।
     বিশিষ্ট শব্দপ্রয়োগ, পদগঠন বা পদান্বয় ব্যবহারের প্রবনেতা, আলঙ্কারিক উদ্দেশ্য প্রভৃতি ভিন্ন ভিন্ন ভাষা লক্ষণ থেকে চিনে নিতে পারি লেখককে । অবশ্য লেখক নিজের স্টাইল সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বদলে ফেলতেই পারেন । তবে এই পরিবর্তন তত দ্রুত হয় না বলেই একটি বিশেষ সময়ে প্রচলিত লেখার ভঙ্গি অনেকক্ষেত্রেই চিহ্নিত করে ফেলা যায় । লেখক রণবীরের গল্পের ভাষা প্রথম দিকে অনেকটাই কঠিন যেখানে তাঁর ‘Text’ –এর তালা খুলতে গিয়ে পাঠককে অনেক সময়েই হোঁচট খেতে হয়, সেখানে পরবর্তী সময়ে লেখক লিখলেন উপন্যাস “সুরমা গাঙর পানি” যার ভাষা একেবারে সহজ এবং সরল । পাঠক অনায়াসেই নিজেকে একাত্ম করে নিতে পারে ‘Text’ –এর সঙ্গে ।
     “সুরমা গাঙর পানি” উপন্যাসের মধ্যে লেখকের Lexical Style বা শাব্দিক শৈলী ধরা পড়ে যখন লেখক তাঁর বয়ান Narrate/ বর্ণনা করছেন এভাবে ---
“ওপারে গুরু সৃষ্টি ধরের ভদ্রাসন দোকান ও শাকসব্জির ‘বিচরা’ ।”
“মা টিলার উপর নিয়ে যেত বাচ্চাটিকে, ‘ডিগরা’ দিয়ে আসত ।”
“হাকালুকি থেকে ও বড় । আর তাঁর ভিতর কত ‘কিসিমের’ মাছ ।”
“তিন চারটে খাগের টুকরো কাগজের ‘তাও’ কয়েকটা সাদা এবং ‘ছেরেং ভেরেং’ লেখায় ।”
“সুন্দরী মেয়েটার জন্যই মাছ ধরে দেয় বৈতল ‘নানানি বিনানি’ ।”
“প্রলয় রাতের অন্ধকারে বাপ বেটা বেরিয়ে যায় এক দড়ি আর এক মস্ত কলসি মাপের ‘খলুই’ হাতে ।”
স্থানীয় জীবনের বাতাবরণ দিয়েই আসলে লেখক তৈরি করেছেন তাঁর উপন্যাসের ভাষা ।
    যে কোনও লেখকই ভাষা-সংস্থানকে (System Of Languages) প্রয়োগ করেন নিজের ইচ্ছে অনুসারে, যার ফলে ভাষা প্রযুক্তির ক্ষেত্রে গড়ে ওঠে তাঁর নিজস্ব এক শৈলী । এখানে ‘বিচরা’, ‘ডিগরা’, ‘কিসিম’, ‘ছেরেং ভেরেং’, ‘নানানি বিনানি’, ‘খলুই’ প্রভৃতি শব্দের মধ্যে রয়েছে লেখকের নিজস্ব Style  বা শৈলী । বর্ণনার ভাষা মান্য হলেও আসলে তো তা তৈরি করতে হয়, লেখক সেখানে সচেতন ভাবেই স্থানীয় ভাষার কিছু কথাবার্তা ঢুকিয়ে দেন, সেটা টুকটাক ছোট করে । উদ্দেশ্য ‘Exception’ গুলোকে ‘Rule’ বানিয়ে ভাষাকে সমৃদ্ধ করা । আর লেখকের এই নিজস্ব ঘোরানাই পাঠাকের মন কেড়ে নেয়  ।
   “সুরমা গাঙর পানি” উপন্যাসে এমন অনেক শব্দ ব্যবহার হয়েছে যার আসলে কোনও মানে বা অর্থ নেই অথচ এর ধ্বনি সুন্দর, কানে ভালো শোনায় এরকম মজার মজার শব্দ । যাকে ধ্বনিতাত্ত্বিক শৈলী বা Phonological Style বলা যায় । যেমন ---
“ঝালের মুখে জিভের ‘চকাশ চকাশ’ আনন্দে মায়ের চোখ ও চিকচিক করে ।”
“খিত্তাগাউ বা রইদপুয়ানি ও যা দিতে পারে নি তাকে, তাই দিয়েছে ‘তেড়া বেঁকা’ এক নদীর পার ।
“ ‘পিটির পিটির’ বৃষ্টির সঙ্গে ‘পুটুর পুটুর’ বিড়ি ফুকতে ফুকতে এসে জড়ো হয় আরো দুই বন্ধু ।”
“তিন চারটে খাগের টুকরো কাগজের ‘তাও’ কয়েকটা সাদা এবং ‘ছেরেং ভেরেং’ লেখায় ।”
এরকম শব্দধ্বনির ফলে, উপন্যাস পড়তে গিয়ে যেন মনেহয় এর আলাদা একটা হৃদম রয়েছে । 
শুধু সংলাপে নয়, ঘটনা ও পরিবেশের ক্ষেত্রে এরকম অনেক শব্দ ব্যবহৃত হয়ে উপন্যাসের প্রাণ সৃষ্টিতে সাহায্য করেছে ।
    উপন্যাসে লেখক যখন বাক্য গঠন করছেন নিজের মতো করে সেখানে ওঠে আসছে তাঁর বাক্যতাত্ত্বিক শৈলী বা Syntactic Style । লেখক লিখছেন, --- 
“শব্দের উৎস কোথায় জানে না বৈতল । ধ্বনি দিয়ে যে শব্দ তৈরি হয় সে কি কোনো ভাষার, কোন ধর্মের । অতশত না জানলে ও তো চলে । বৈতল জানে তিন শব্দে শরৎ আসে বইয়াখাউরিতে, শিউলি ফোটে । বিলে শালুক ফোটে, পদ্ম চোখ মেলে । উৎসবের অগ্রদূত হয়ে আসে বাদ্যি, ঢ্যাম কুড়াকুড় ।”...
কিংবা সংলাপে লাখুদা যখন বৈতলকে জবাব দিচ্ছেন ---
“নালিয়া গাছ আর বড় করিয়া লাভ নাই কইছি, কচি দেখিয়া আগপাত বেচিলাউক মাইনষে গিট্‌টো দেওয়ার লাগি নিবা । খাইছ নি বা নালী গিট্‌ ।”
    এরকম বাক্যগঠন পাঠককে পরিচয় করিয়ে দেয় লেখকের লেখক সত্তার পাশাপাশি ব্যাক্তিসত্তার সাথেও ।
     প্রত্যেক আখ্যানের ভাষাশৈলীর দুটো ভাগ থাকে – বর্ণনা এবং সংলাপ । বর্ণনার ভাষা সাধারণত মান্য ভাষায় হয়, কিন্তু সংলাপের ভাষা মান্য ভাষা এবং স্থানীয় উপভাষা দুটোতেই হয় । এসব ক্ষেত্রে লেখকের ভাষাগত বৈশিষ্ট্য নির্ধারিত করে দিতে পারে তাঁর স্থানিক পরিচয় বা সামাজিক শ্রেণী । Class Dialect বা শ্রেণী-উপভাষার ব্যবহার লেখকের সামাজিক স্তর সম্পর্কে পাঠককে ওয়াকিবহাল করে । “সুরমা গাঙর পানি” উপন্যাসের সংলাপ রচিত হয়েছে স্থানীয় উপভাষায় । কাহিনীতে চরিত্রের সংলাপগত উপস্থাপনার ফলে প্রায় সব চরিত্রের আঞ্চলিক ও শ্রেণীগত পরিচয়টি পাঠকের কাছে স্বচ্ছ হয়ে ওঠে ।
    উপন্যাসের দুটি পর্বে – ভাটি এবং উজান পর্বে দুরকমের স্থানীয় উপভাষার ব্যবহার হয়েছে । ভাটি পর্বে সুনামগঞ্জ, হবিগঞ্জ, বইয়াখাউরির ভাষা দেখা যাচ্ছে আবার উজান পর্বে এসে শহরের সিলেটী এবং কাছাড়ি উপভাষার এক জগাখিচুড়ি ভাষা সৃষ্টি হয়েছে । দেশভাগের সময়ে সিলেটে গ্রামে গ্রামে, এলাকায় এলাকায় একরকমের ভাষা দেখা যাচ্ছে আবার যখন কাহিনী উজান পর্বে চলে আসে তখন ভাষার একটা মিশ্রণ দেখা যাচ্ছে । ভাটি পর্বে হিন্দুরা সবাই উচ্চবর্ণের এখানে এসে ভাষা মিশে গেছে । উজানপর্বে স্থানীয় এরা কোথা থেকে আসে নি । তাদের একটা নিজস্ব কাছাড়ি উপভাষা রয়েছে । সেটা মুসলমানদের মুখের কথ্য ভাষা । উপন্যাসে আমরা লক্ষ্ম্য করলে দেখব বৈতল যখন তার মুসলমান বন্ধু লুলার সাথে কথা বলছে সে বলছে ‘তুই’ আবার লুলা যখন বৈতলকে কিছু বলছে, বলছে ‘তুইন’ । ‘তুই’ সম্বোধনটা ‘তুইন’ হয়ে যাচ্ছে । উজান পর্বে এসে সব মিশে গিয়ে মুসলমানি কাছাড়ি উপভাষা হয়ে যাচ্ছে । দুখু বৈতলের সংলাপেও তা দেখা যায় ---
“হুনছি তো । ‘তুইন’ কইছে । তুইন অতো পাকিস্তান তনে আইচছ ।”
“আইছিতে কিতা, আমি অখন পাকিস্তানি নি । ‘তুইতো’ হালার হালা গদ্দার ।”...
    উপন্যাসে ব্যবহার হয়েছে নাগরিক ভাষা, ব্যবহার হয়েছে একেবারে সাধারণ খেঁটে খাওয়া মানুষের ভাষা । উঠে এসেছে গ্রামিন বৈশিষ্ট্য, গ্রামের কিছু বোকা বোকা ব্যাপার, গ্রামের মানুষের মনের কথা মুখের ভাষা । রয়েছে অনেক সুস্বাদু খাবারের উপকরণ একেবারে স্থানীয় ভাষায় স্থানীয় রীতিতে । মুখের ভাষার মধ্যে ওঠে আসে সামাজিক অবস্থান, সমাজের কথা ---
“না গো না, মা বিষরি । কেউ কেউরে খেদায় না । মানুষ মানুষর শত্রু নায় । খালি দুই একজন আলদর বাইচ্চা থাকে । শয়তানি করে ।”
    লেখক নিজস্ব সৃষ্টির প্রয়োজনেই উপন্যাসে চরিত্রের কল্পনায়, ভাষার গঠনে ব্যবহার করেছেন লোকসাহিত্যের নানা দিক, যা উপন্যাসের ভাষাকে নতুনত্ব এনে দিয়েছে । অনেক লৌকিক ছড়া ও গানের ব্যবহার হয়েছে উপন্যাসে যা সহজেই পাঠকের দৃষ্টি কেড়ে নেয় ।
 ‘ছাতক তনে আইলা এক আড়ুয়া, যাইতা বদরপুর ।
                   সিলট আইয়া জিগার করলা, জৈন্তা কতদূর ।’
বা বৈতল যখন শেখাচ্ছে মেয়েকে ঘুঙ্গিঘুঙ্গি খেলা । ঘুঙ্গিরে ঘুঙ্গি তোর বাড়ি কৈ । দুল দুল দুলনি রাঙা মাথায় চিরুণি, দুপায়ের উপর মেয়েকে বসিয়ে দোলাতে দলাতে বৈতলের গলা চড়ে সবার আগে আর বলতে থাকে হেট্‌ ঘোড়া বদরপুর, মঙ্গলবাজার কতদূর । উপন্যাসে বৈতলের মেয়ের সবচে মজার খেলা হল গু খাওয়ার ছড়া,  
‘একখান কথা,
কী কথা ।
বেঙের মাথা ।
কী বেঙ ।
ঘাড়ু বেঙ ।
কী ঘাড়ু ।
বাবন গরু ।
কী বাবন ।
ভট বাবন ।
কী ভট ।
গুয়া কট ।
কী গুয়া ।
ছাও গুয়া ।
কী ছাও ।
গু খাও ।’
উপন্যাসে এরকম স্থানীয় লোকখেলা, লোকভাষা, লোকগান, ছড়া প্রভৃতি ব্যবহার করে পাঠককে আলাদা আনন্দে ভরপুর করে দিতে সক্ষম হয়েছেন লেখক । 
     বলা হয়ে থাকে ভাষা সৃষ্টির জন্যে অন্তত দুটো মানুষের অস্তিত্ব প্রয়োজন । সাহিত্যে যখন সংলাপ হচ্ছে দুটো মানুষের মধ্যে বা চরিত্রের মধ্যে তখন সৃষ্টি হচ্ছে নতুন ভাষার । উপন্যাসে প্রধান চরিত্র বৈতলের সঙ্গে অন্য চরিত্রের সংলাপের মধ্য দিয়েই সৃষ্টি হয়েছে নতুন অর্ন্তবয়ান । আর যখনই একের বেশি দুয়ে আমরা আসি তখনই সৃষ্টি হয় সমাজ --- “সুরমা গাঙর পানি” উপন্যাসের মধ্যে তেমনি ওঠে এসেছে সেই সমাজের ভাষা, মাছ মারাদের জীবনকাহিনী । স্থানীয় ভাবধারা, জীবন প্রণালী, রীতিনীতি, আচার ব্যবহার একেবারে স্থানীয় ভাষায় নিজস্ব রীতিতে নিজস্ব ঘরানায় উপন্যসে সার্থকভাবে তুলে দিয়েছেন লেখক ।   
     আর ভাষাবিজ্ঞান, শৈলীবিজ্ঞান দিয়ে যখন আমরা “সুরমা গাঙর পানি” উপন্যাস পাঠ করি তখন শুধু জীবনানুভূতির তত্ত্বকথাই নয়, পাই লেখকের নিজস্ব শিল্পকলাও ।  




অঙ্গীকার, পূজো সংখ্যা ২০১৫ 
শিলচর ।